সুমন ইসলাম :
চলতি বছর প্রজনন মৌসুমে আশানুরূপ ডিম ছাড়তে পারেনি মা ইলিশ। তবে এখনও বিষয়টি গবেষণাধীন থাকায় কেউ তথ্য স্পষ্ট না করলেও গত বছরের চেয়ে কিছুটা কম হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানাগেছে। এ বছর মা মাছের ডিম ছাড়ার সম্ভাবনা ৫১-৫২ এর মধ্যে। গত বছর ডিম ছেড়েছিল ৫২.৫ ভাগ মা মাছ। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে ডিম ছাড়ার পরিমাণ কম হলেও আগামী বছর ইলিশের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে।
চাঁদপুর মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও প্রখ্যাত ইলিশ গবেষক ড. আনিসুর রহমান বলেন, ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধের সময়ে নানা জায়গায় বিচ্ছিন্নভাবে কিছু ইলশ ধরা পরলেও তা খুব একটা সমস্যা তৈরি করে না। তবে ডিম ছাড়ার জন্য প্রয়োজনীয় অনুকুল পরিবেশ না পেলে কিছুটা তারতম্য হয়ে থাকে। চলতি বছর পরিবেশ কিছুটা খারাপ থাকলেও ডিম চাড়ার পরিমাণ খুব একটা হের ফের হবে না। গত বছরের তুলনায় সামান্য কিছু টা কম হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তিনি আরো বলেন, আমি দীর্ঘ দিন গবেষণায় দেখেছি- পরিবেশ কিছুটা অনুকূলে থাকলেও ৪৫-৫০ ভাগ মা ইলিশ ডিম ছাড়ার পরিবেশ পেয়ে থাকে। আর মা ইরিশ যে ডিম ছাড়ে তার থেকে যদি ১০ শতাংশ ডিম ফুটার সুযোগ পায় তাহলেও ৩৫ থেকে ৪০ হাজার কোটি ইলিশের পোনা (জাটকা) নদীতে উৎপন্ন হয়ে থাকে। কিছু নিয়ম অনুসরণ করতে পারলে আগামীতে ইলিশের উৎপাদন আরও বৃদ্ধি পাবে বলে আশাবাদী এই ইলিশ গবেষক।
আশ্বিনের ভরা পূর্ণিমা ও অমাবশ্যাকে কেন্দ্র করে নদীতে ডিম ছাড়ে মা ইলিশ। এ সময়টাতে প্রজনন মৌসুম হিসেবে মা ইলিশকে ডিম ছাড়ার সুযোগ করে দিতে হবে। এ জন্য চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনাসহ দেশের ৭টি উপকূলীয় এলাকায় সব ধরনের মাছ ধরা বন্ধ করে সরকার। এরপরও প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে অনেক অসাধু জেলে এই সময়টাতে ইলিশ শিকার করে। এ সময়ে জেলেদের বিকল্প আয়োরও ব্যবস্থা করা প্রয়োজন বলেও তিনি মনে করেন।
ইলিশ গবেষক ড. আনিছুর রহমান বলেন, ইলিশ মাছ পরিভ্রমণ স্বভাবের। প্রজননের সময়টাতে তারা সাগর ছেড়ে সাগর মোহনা ও নদ-নদীতে ছুটে আসে। প্রজননের মৌসুমে ইলিশের অভয়াশ্রম কার্যক্রম বাস্তবায়নের ফলে প্রতিবছর দেশে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইলিশ যাতে করে সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যে রাখা যায় এ জন্যও সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চাঁদপুর মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক ইলিশ গবেষক বলেন, আমরা আমাদের টিম নিয়ে মা ইলিশে নিষেধাজ্ঞা জারির আগ থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পরেও সরেজমিন কাজ করেছি। তার মতে গত বছরের মতোই মা ইলিশ ডিম ছেড়েছে, তবে পানির নিচের মাছের সংখ্যা বা পরিমাণ স্পষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। তবে কিছুটা ধারণা দেওয়া যেতে পারে। তারা এখন অফিসিয়াল এ্যানালাইসিস করছেন। দ্রুত সময়ের মধ্যে ফলাফল মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ মন্ত্রনালয়ে পাঠানো হবে।
চাঁদপুর মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট সূত্র জানায়, প্রতিবছরই মা ইলিশের ডিম ছাড়ার পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১৬ সালে ৪৩ দশমিক ৪৫ ভাগ, ২০১৭ সালে ৪৬ দশমিক ৪৭ ভাগ, ২০১৮ সালে ৪৭ দশমিক ৭৫ ভাগ এবং ২০১৯ সালে ৪৮ দশমিক ৯২ ভাগ ইলিশ নদীতে ডিম ছাড়ার সুযোগ পেয়েছে। ২০২০ সালে ৫১ দশমিক ২ ভাগ, ২০২১ সালে ৫১ দশমিক ৭ ভাগ, ২০২২ সালে ৫২ ভাগ , ২০২৩ সালে ৫২ দশমিক ৫ ভাগ মা ইলিশ ডিম ছেড়েছিল।
সংশ্লিষ্টরা আরও বলেন, ডিম ছাড়ার পরিমাণ ৫১-৫২ ভাগের মধ্যে হলেও ১০ ভাগ ডিম টিকলে, প্রায় ৪০ কোটি জাটকা পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যদি জাটকা সংরক্ষণ মৌসুমে অভিযান সফল করা যায়, তাহলে প্রচুর ইলিশ পাওয়া যাবে।
মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুসারে, দেশে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৩ দশমিক ৮৮ লক্ষ টন, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৩ দশমিক ৯৫ লক্ষ টন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৪ দশমিক ৯৭ লক্ষ টন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৫ দশমিক ১৭ লক্ষ টন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৫ দশমিক ৩৩ লক্ষ টন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫ দশমিক ৫ লক্ষ টন, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫ দশমিক ৬৫ লাখ টন এবং গেল ২০২১-২২ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদন ৫ দশমিক ৬৬ লাখ টন, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদন ৫ দশমিক ৭১ লাখ টনে দাঁড়িয়েছে।