কৃষি সংবাদ প্রতিবেদক:
আন্তর্জাতিক মিঠাপানির ডলফিন দিবস আজ (২৪ অক্টোবর),২০২৪। প্রতিবছরের মতো এবারও বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে দিনটি পালন করা হবে। এ বছর দিবসের প্রতিপাদ্য ‘নদীর প্রাণ ডলফিন-শুশুক, নিরাপদে বেঁচে থাকুক’।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিপন্ন প্রাণী ডলফিন বাঁচাতে সরকার ১০ বছর মেয়াদি ‘ডলফিন কনজারভেশন অ্যাকশন প্ল্যান’ ২০২২ সালে অনুমোদন করেছে। এই প্ল্যানের আওতায় কাজ চলছে।
মিঠা পানির ডলফিন সংরক্ষণে সচেতনতা বাড়াতে ২০০৯ সালের ২৪ অক্টোবর ইন্দোনেশিয়ায় বিশ্বব্যাপী মিঠা পানির ডলফিন দিবস পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়। এরপর থেকে বাংলাদেশে প্রতিবছর দিনটি পালিত হয়ে আসছে। দিবসটি উপলক্ষে বন অধিদফতরে আলোচনা সভার আয়োজন করেছে বন, পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রনালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ান হাসান। এ ছাড়া মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আলোচনায় অংশ নেবেন।
ঢাকায় বন ভবন, ছাড়াও পাবনা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা ও বাগেরহাটে বিভিন্ন জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশে মোট ১১ প্রজাতির ডলফিন আছে। মিঠা পানিতে এক প্রজাতির ডলফিন বাস করে, যাকে শুশুক বলা হয়। নোনা ও মিঠা পানির মিলনস্থলে পাওয়া যায় ইরাবতী ডলফিন। যেখানে নোনা পানি বেশি, সেখানে আরও ৯ প্রজাতির ডলফিন বাস করে। বর্তমানে নানা কারণে ডলফিন হুমকির মুখে।
পরিবেশমন্ত্রনালয় সূত্র জানায়, ডলফিন রক্ষায় ‘ডলফিন কনজারভেশন অ্যাকশন প্ল্যান’ কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। ডলফিন ও এর আবাসস্থল সংরক্ষণ ছাড়াও ‘ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান ফর দ্য গ্যাঙ্গেজ রিভার ডলফিন ইন হালদা রিভার’ ডলফিন সংরক্ষণে কর্তৃপক্ষের জন্য নির্দেশক হিসেবেও কাজ করছে। ডলফিন কনজারভেশন টিম যাতে সরকার প্রদত্ত অর্থ সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে ডলফিন সংরক্ষণ কার্যক্রম দীর্ঘদিন চালিয়ে যেতে পারে, এ জন্য ‘ফান্ড ম্যানেজমেন্ট গাইডলাইন’ প্রণয়ন করা হয়েছে।
‘ডলফিন কনজারভেশন অ্যাকশন প্ল্যান’-এর বিষয়ে জানা গেছে, এই প্ল্যানের আওতায় সারা দেশে ২৬টি পয়েন্টে একশন প্ল্যান করা হয়েছে। ডলফিন বাচাতে সাধারণ মানুষের সচেতনতা বাড়াতে চলছে প্রচারণার কাজ।
এবার ডলফিন দিবস শুধু কেন্দ্রীয়ভাবে নয়, সারা দেশেই করা হচ্ছে। বিভিন্ন স্পটে এবার জনসভা করা হবে। এখন পর্যন্ত ৯টি ডলফিনের অভয়ারণ্য আছে। সেগুলোতে স্থানীয়দের নিয়ে ডলফিন রক্ষায় সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ চলমান। এই প্ল্যানের ২০২১ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত মেয়াদ। এর মধ্যে ধাপে ধাপে কাজগুলো করা হবে।
আই.ইউ.সি.এন এর গ্লোবাল রেড লিস্ট ক্যাটাগরিতে দুটোই বিলুপ্তির ঝুঁকির সম্মুখীন বা ‘এন্ডেঞ্জার্ড এনিম্যাল’। ইরাবতীদের বাস আমাদের ৭২০ কিমি উপকূলীয় নদী কিংবা সাগরমুখে আর শুশুক ডলফিন বিচরণ করছে দেশে বিদ্যমান ৭০০ নদীর ২৪ হাজার কিমি এলাকার একটি বড়ো অংশ জুড়ে। যদিও বর্ষা মৌসুম ব্যতিরেকে শুষ্ক মৌসুমে এদের আবাসস্থল কমে বেশ সংকুচিত হয়ে যায়। আশার কথা হলো আমাদের প্রমত্তা পদ্মা, যমুনা, মেঘনাসহ, ব্র্রহ্মপুত্র, হালদা, বলেশ্বর, গড়াই-মধুমতী, ডাকাতিয়া প্রভৃতি নদীই রিভার ডলফিনের উপযুক্ত আবাসস্থল।
বাংলাদেশে গঙ্গা নদীর ডলফিনসহ অন্যান্য প্রজাতির ডলফিন বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে। এর প্রধান কারণ হলো নদীর দূষণ, মাছ ধরার জাল, জলবিদ্যুৎ বাঁধ, এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নদীর প্রবাহে পরিবর্তন। এদের সংখ্যা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে, যা আমাদের বাস্তুসংস্থানকে ঝুঁকিতে ফেলছে।
বাংলাদেশ সরকার এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে ডলফিন সংরক্ষণে বেশ কিছু কার্যক্রম শুরু করেছে। গঙ্গা নদীর ডলফিন সংরক্ষণে বিশেষ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে ডলফিনের বাস্তুসংস্থান উন্নত করার পাশাপাশি তাদের সংখ্যা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ডলফিনের আবাসস্থল সংরক্ষণ এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রম নেয়া হয়েছে। গাঙ্গেয় ডলফিনকে সংরক্ষিত প্রজাতির মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে, যা এদের রক্ষার প্রচেষ্টায় গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
দেশব্যাপী ডলফিন সংরক্ষণ কার্যক্রম আরও জোরদার করার জন্য এবং বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বন অধিদপ্তর শুশুক বা গাঙ্গেয় ডলফিনকে জাতীয় জলজ প্রাণী হিসেবে ঘোষণা করার প্রস্তাব করেছে। এই প্রস্তাবটি অনুমোদন করা হলে ডলফিন সংরক্ষণ আরও গুরুত্ব পাবে বলে আশা করা যায়। এর বাইরে, মিঠা পানির ডলফিন সংরক্ষণে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে কাজ করছে বাংলাদেশ সরকার।
গবেষণার পাশাপাশি ডলফিনের গতিবিধি ও স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ এবং প্রজনন সংক্রান্ত উদ্যোগও গ্রহণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া, বিভিন্ন নদীতে পর্যটন নিয়ন্ত্রণ ও নদী দূষণ রোধে আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ বাড়ানো হয়েছে।পরিবেশবিদরা বলছেন, ডলফিন সংরক্ষণে সফলতা পেতে হলে সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণ ও সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। প্লাস্টিক, রাসায়নিক পদার্থ, এবং অপ্রয়োজনীয় বর্জ্য নদীতে ফেলার ফলে ডলফিনের আবাসস্থল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বন অধিদপ্তরের টেকসই বন ও জীবিকা (সুফল) প্রকল্পের আওতায় ‘ডলফিন কনজারভেশন প্রোগ্রামস ইন যমুনা, হালদা এন্ড আদার ইম্পর্টেন্ট রিভারস’ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে, ডব্লিউসিএস বাংলাদেশ গাঙ্গেয় ডলফিনের উপর ব্যাপক পর্যালোচনা ও গভীরতার সমীক্ষা পরিচালনা করে। বাংলাদেশ মেঘনা ও এর শাখা নদী, পদ্মা, যমুনা, কর্ণফুলী এবং হালদা নদীর ১ হাজার ৯০৫ কিমি এলাকাজুড়ে নদীর ডলফিনের ভিজ্যুয়াল বোট-ভিত্তিক সমীক্ষা পরিচালনা করা হয়। দুটি স্বাধীন পর্যবেক্ষক দল দ্বারা সমীক্ষা চালানো হয়। এই সমীক্ষার ফলে প্রায় ৬৩৬টি দল বা ১ হাজার ৩৫২টি গাঙ্গেয় ডলফিনের উপস্থিতি নির্ধারণ করা হয়।